পঞ্জিকা
- Dec 6, 2024
- 9 min read
পঞ্চ অঙ্গ যাহার তাহাই পঞ্জিকা যেমন - বার , তিথি , নক্ষত্র , করণ ও যোগ ।
==================================
পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার হলো দিনের হিসাব করার জন্য ব্যবহার করার পদ্ধতি। মূলত কৃষিকাজের জন্য এই পঞ্জিকার আবির্ভাব হয়েছিল। পঞ্জিকা বছরের প্রতিদিনের তারিখ, তিথি, শুভাশুভ ক্ষণ, লগ্ন, যোগ, রাশিফল, বিভিন্ন পর্বদিন ইত্যাদি সংবলিত গ্রন্থ। একে পঞ্জী বা পাঁজিও বলা হয়। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে একে বলা হয়েছে ‘পঞ্চাঙ্গ’। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও এটি এই নামে পরিচিত। এর কারণ এতে বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ প্রধানত এই পাঁচটি অঙ্গ থাকে। বাংলায় অবশ্য এটি পঞ্জিকা নামেই সুপরিচিত।
সভ্যতা বিকাশের শুরু থেকেই সমাজসচেতন ব্যক্তিদের চিন্তা-চেতনায় কালবিভাগের ধারণাটি আসে। প্রয়োজনের তাগিদে তখন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন উপায়ে বছর, মাস, দিন ও তারিখ গণনার কৌশল আবিষ্কৃত হয়। কালক্রমে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের পাশাপাশি পূজা-পার্বণের সময়-নিরূপণও পঞ্জিকা প্রণয়নের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
কালনিরূপণে বিভিন্ন দেশে ভিন্নরকম পদ্ধতি ব্যবহূত হয়েছে। বৈদিক যুগের ঋষিরা বিভিন্ন ঋতুতে নানারকম পূজা-পার্বণ করতেন। সে কারণে তাঁরা বিশেষ ঋতুবিভাগের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তাঁরা ঋতুভিত্তিক বছর হিসেব করে বছরকে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন এই দুভাগে ভাগ করতেন। সূর্য উত্তরদিকে আগমন করা থেকে উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণদিকে যাত্রা করা থেকে দক্ষিণায়ন গণনীয় হতো। প্রাচীন মনীষিগণ বছরকে বারো ভাগে বিভক্ত করেন, যেমন: তপঃ, তপস্যা, মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ইষ, ঊর্জ, সহস্ ও সহস্য। তপঃ থেকে শুচি পর্যন্ত উত্তরায়ণ এবং নভস্ থেকে সহস্য পর্যন্ত দক্ষিণায়ন। অনুমান করা হয় যে, এরূপ সময়বিভাগ যর্জুবেদের কালে (১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) প্রচলিত ছিল। তিথির প্রচলন হয় অনেক পরে। শুধু সেই সময়কালে পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টকা ব্যবহূত হতো। কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে গণনা করে ২৭টি বা ২৮টি নক্ষত্রে ভ-চক্রকে বিভক্ত করা হতো। এটাই এতদঞ্চলের পঞ্জিকা গণনার আদিরূপ। বৈদিক সাহিত্যে ফাল্গুনী পূর্ণিমার উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে অনুমিত হয় যে, তখন চান্দ্রমাস গণনার প্রচলন ছিল, যা পূর্ণিমান্ত মাস নামে পরিচিত।
সময়ের বিবর্তনে এবং মানুষের প্রয়োজনে অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পঞ্জিকা প্রবর্তিত হয়। ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি এ জাতীয় পঞ্জিকায় বছর আরম্ভ হতো উত্তরায়ণ দিবস থেকে এবং তাতে ১২টি চান্দ্রমাস ব্যবহূত হতো। এই পঞ্জিকায় ৩০টি তিথি এবং ২৭টি নক্ষত্র গণনার নিয়ম ছিল। তখন প্রতি পাঁচ বছরে একটি যুগ গণনা করা হতো এবং এক যুগ পরপর এই পঞ্জিকা গণনার পদ্ধতি আবর্তিত হতো। ওই সময় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তিথ্যন্ত প্রভৃতি কাল গণনার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। মাত্র মধ্যমমানে প্রতিদিন এক তিথি এক নক্ষত্র এই হিসেবে তিথ্যাদি নির্ণয় করা হতো এবং মাঝে মাঝে এক-একটি তিথি হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হতো। পঞ্চবর্ষাত্মক যুগ ব্যতীত কোন অব্দ গণনার প্রথা তখনও প্রবর্তিত হয়নি। দেড় হাজার বছর ধরে কাল গণনা ও পূজা-পার্বণের সময় নিরূপণের কাজে এরূপ বেদাঙ্গজ্যোতিষ পঞ্জিকা খুবই সমাদৃত ছিল।
পঞ্জিকার উন্নতি সাধনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা গবেষণা চালাতে থাকেন এবং খ্রিস্টীয় ৪র্থ বা ৫ম শতকে তাঁরা সূক্ষ্ম গণনার কৌশল আয়ত্ত করেন। এসব বিষয়ে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁরা হলেন আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমুখ। তাঁরা পঞ্জিকার গণনাকে জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তিথ্যাদির সূক্ষ্ম কাল গণনার সূত্রাদি দ্বারা দৈনিক গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, লগ্ন, ক্ষণ, তিথি প্রভৃতির পূর্তিকাল পঞ্জিকার মধ্যে পরিবেশনের ব্যবস্থা করেন। এতে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সহজেই পঞ্জিকা থেকে পাওয়া যেত। এক্ষেত্রে সূর্যসিদ্ধান্ত জ্যোতির্বিদ্যার একখানি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মূল্যবান গ্রন্থ। এটিকে আধুনিক পঞ্জিকার জনক বলা যায়। পরে সূর্যসিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই পঞ্জিকার সবকিছু গণনা করা হতো। পঞ্জিকার মধ্যে তখন স্থান পেত বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণযুক্ত প্রতিদিনের পঞ্চাঙ্গ এবং তা তালপাতায় লিপিবদ্ধ করে গণকঠাকুর বা ব্রাহ্মণরা বছরের প্রারম্ভে গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে মানুষদেরকে অবহিত করতেন বা জনগণের সুবিধার্থে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এর অনুলিপি সংরক্ষণ করতেন। এসবের ভিত্তিতে পূজা-পার্বণাদি বা ধর্মকৃত্য সাধনের কালও নির্ণয় করা হতো।
পঞ্জিকা অপভ্রংশে পাঁজি, নামটি এসেছে পঞ্চাঙ্গ থেকে। পঞ্চাঙ্গের অর্থ পঞ্জিকার ৫টি অঙ্গ।
১। বার বা বাসর: – সোমবার থেকে রবিবার বা সোমবাসর থেকে রবিবাসর।এই প্রত্যেকটি নাম গ্রহ থেকে এসেছে। রবি- সূর্য্য, সোম- চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি বা গুরু, শুক্র বা ভার্গব, শনি।
২। তিথি: – সূর্য্যের সঙ্গে সংযোগের হিসাবে চান্দ্রমাসের গড় মান-২৯.৫৩ দিন। চান্দ্রমাস কাকে বলা হয়? এক অমাবস্যা থেকে ঠিক পরের অমাবস্যা পর্য্যন্ত সময়কে সাধারণত ১ চান্দ্রমাস বলা হয়। চান্দ্রমাসের নামকরণ কিভাবে হয়? আমরা জানি ১২ টি সৌরমাস। যথা:- ১. বৈশাখ( বিশাখা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে)
২. জ্যৈষ্ঠ(জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে)
৩.আষাঢ়(পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে)
৪. শ্রাবণ (শ্রবণা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে)
৫.ভাদ্র (পূর্বভাদ্রপদ নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে)
৬. আশ্বিন (অশ্বিনী নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে)
৭.কার্ত্তিক ( কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে)
৮. অগ্রহায়ণ ( অপর নাম- মার্গশীর্ষ, মৃগশিরা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ৯. পৌষ (পুষ্যা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে)
১০. মাঘ (মঘা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে)
১১.ফাল্গুন (পূর্বফল্গুনি নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে)
১২.চৈত্র (চিত্রা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ।
আমরা বৈশাখ থেকে আরম্ভ করি। এই মাসের কোন না কোন দিনে অমাবস্যা পড়বে। এই অমাবস্যা থেকে পরের অমাবস্যা পর্যন্ত ১ চান্দ্র বৈশাখ বলা হয়। এইভাবে ১২টি চান্দ্রমাস হবে। যদি একই মাসে ২ টি অমাবস্যা পড়ে, তবে সেই চান্দ্রমাস মলমাস হিসাবে গণ্য হবে। আগেই বলা হয়েছে যে, এক চান্দ্রমাসের মান ২৯.৫৩ দিন। ২৯.৫৩ কে পূর্ণসংখ্যাতে রুপান্তরিত করলে হয় ৩০। এই ৩০ দিনকে ৩০ টি সমান ভাগে ভাগ করে, এক একটি অংশকে বলা হয় তিথি। তিথি হলো ১ চান্দ্রদিন। এবার প্রশ্ন কেন? অমাবস্যা কে আদি তিথি বা ১ম দিন ধরা হয়? যখন চন্দ্র ও সূর্য্যের একই সরলরেখায় মিলন হয় তখন অমাবস্যা হয় । সুতরাং তিথি= ১ চান্দ্রদিন। অমাবস্যার পরের দিন প্রতিপদ বা প্রথমা এবং শুরু শুক্লপক্ষ। সুতরাং অমাবস্যার পরের দিন শুক্লপক্ষের প্রতিপদ বা প্রথমা। চন্দ্র, সূর্য্যের সাপেক্ষে ১২ ডিগ্রী কৌণিক দূরত্ব (angular distance) অতিক্রম করলেই প্রতিপদ বা প্রথমার শেষ এবং শুক্লা দ্বিতীয়ার আরম্ভ।
পক্ষ ২টি। শুক্লপক্ষ এবং কৃষ্ণপক্ষ। পক্ষ সাধারণত ১৫ দিনের। অমাবস্যা থেকে পরের ১৫ দিন পর পূর্ণিমা। এই ১৫ দিন শুক্লপক্ষ । আবার পূর্ণিমা থেকে পরের ১৫ দিন পর অমাবস্যা। এই ১৫ দিন কৃষ্ণপক্ষ। সুতরাং ১ চান্দ্রমাসের ১ম ১৫ দিন শুক্লপক্ষীয় এবং ২য় ১৫ দিন কৃষ্ণপক্ষীয়। তিথি, যে কোন দিনাঙ্কের যে কোন সময়ে শুরু হতে পারে; দিনে অথবা রাত্রিতে। সাধারণত পঞ্জিকার যে কোন দিনাঙ্কের সূর্য্যোদয়ের সময় যে তিথি চলছে সেটাই সেই সৌরদিনের তিথি হিসাবে গণ্য হবে। তিথির মান ২০ থেকে ২৭ ঘণ্টা পর্য্যন্ত হতে পারে। এর কারণ চন্দ্রের জটিল গতি। চন্দ্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে এক কক্ষপথে ঘুরে চলেছে, এটা আমরা সবাই জানি। কক্ষপথটি কিন্তু উপবৃত্তাকার (Elliptical)| যার ফলে চন্দ্রের গতি সেই কক্ষপথে সব জায়গায় সমান নয়। কখনো ধীরে, কখনো জোরে।–আর সেই জন্যেই তিথির মান ২০ থেকে ২৭ ঘণ্টা পর্য্যন্ত হয়। সুতরাং, পাঁজির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হোল তিথি ।
এবার নক্ষত্র: – নক্ষত্র ২৭ টি। ক্রমানুসারে ২৭ টি নামগুলি হোল: – ১। অশ্বিনী
২। ভরণী
৩। কৃত্তিকা
৪। রোহিণী
৫। মৃগশিরা
৬।আর্দ্রা
৭। পুনর্বসু
৮। পুষ্যা
৯। অশ্লেষা
১০। মঘা
১১। পূর্বফাল্গুনি
১২। উত্তরফাল্গুনি
১৩। হস্তা
১৪। চিত্রা
১৫। স্বাতী
১৬। বিশাখা
১৭। অনুরাধা
১৮। জ্যেষ্ঠা
১৯। মূলা
২০। পূর্বাষাঢ়
২১। উত্তরাষাঢ়া
২২। শ্রবণা
২৩। ধনিষ্ঠা
২৪। শতভিষা
২৫। পূর্বভাদ্রপদ
২৬। উত্তরভাদ্রপদ
২৭। রেবতী ।
এছাড়াও অভিজিৎ নামেও আরও একটি নক্ষত্র আছে। উত্তরাষাঢ়ার শেষ পাদ এবং শ্রবণার প্রথম পঞ্চদশাংশ ব্যাপী অভিজিৎ নক্ষত্র গণণা করা হয়। অর্থাৎ: – ৯ রাশি ৬ অংশ ৪০ কলা থেকে ৯ রাশি ১০ অংশ ৫৩ কলা ২০ বিকলা পর্য্যন্ত। এখন নক্ষত্র বলতে কি বুঝব? মূলত চন্দ্র রাশিচক্রের (প্রকৃতপক্ষে চান্দ্রমার্গের) ৩৬০ডিগ্রী ঘুরে আসে। এই চন্দ্র রাশিচক্রের ভাগ ২৭ টি। প্রত্যেকের ব্যবধান হোল ১৩ ডিগ্রী ২০ মিনিট । এই এক একটি ভাগকে নক্ষত্র বলা হয়। এই ভাগের প্রধান উজ্জ্বল তারাকে যোগতারা বলা হয়। কোন দিন কোন নক্ষত্র বললে বুঝতে হবে চন্দ্রের অবস্থান নক্ষত্রের ১৩ ডিগ্রী ২০ মিনিট সীমানার মধ্যে।
৩।করণ: – করণ হোল তিথির ১/২ বা অর্ধাংশ। যে কোন তিথির প্রথম অর্ধাংশ একটি করণ, দ্বিতীয় অর্ধাংশ অন্য একটি করণ। সুতরাং ৩০টি তিথিতে ৬০ টি করণ। করণের নামগুলো: – ১। বব
২। বালব
৩। কৌলব
৪। তৈতিল
৫। গর
৬। বণিজ
৭।বিস্টি
৮।শকুনি
৯।চতুষ্পাদ
১০। নাগ
১১।কিন্তুঘ্ন
প্রথম ৭টি করণ চরকরণ বা সাধারণকরণ। পরের ৪টি স্থিরিকরণ। ৪টি স্থিরিকরণ বিশেষ বিশেষ তিথির বিশেষ বিশেষ অর্ধাংশে প্রযোজ্য। কৃষ্ণচতুর্দশীতে-১টি, অমাবস্যায় -২টি, শুক্ল প্রতিপদে- ১টি । এই ৪টি স্থিরিকরণ । এই ৪টি বাদ দিলে থাকে ৫৬ টি করণ। এই ৫৬ টি করণের প্রথম ৭টি চরণাকরণের পৌনঃপুনিক (Recurring) মাত্র।
৪।যোগ: – পঞ্জিকার শেষের অঙ্গটি হলো যোগ। সূর্য্য ও চন্দ্রের দুইয়ের নিরয়ণস্ফুট (Longitude) যা দেওয়া থাকে তাদের যোগফলকে ১৩.৩৩ দিয়ে ভাগ করলে যা থাকবে – তাই যোগ। তিথি ও নক্ষত্রের মত যোগেরও অন্তকাল থাকে। যোগ ২৭ টি: – (ক্রমানুসারে) ১। বিষ্কুম্ভ ২। প্রীতি ৩। আয়ুষ্মান ৪। সৌভাগ্য ৫। শোভন ৬। অতিগন্ড ৭। সুকর্মা ৮। ধৃতি ৯। শূল ১০। গন্ড ১১। বৃদ্ধি ১২। ধ্রুব ১৩। ব্যাঘাত ১৪। হর্ষণ ১৫। বজ্র ১৬। অসৃক ১৭। ব্যাতিপাত ১৮। বরীয়ান ১৯। পরিঘ ২০। শিব ২১। সিদ্ধ ২২। সাধ্য ২৩। শুভ ২৪। শুক্র (শুক্ল) ২৫। ব্রহ্ম ২৬।ইন্দ্র ২৭। বৈধৃতি এগুলো গেল পঞ্জিকার সময় গণণা। এবার আসি কিছু পুরোনো সময়ের অর্থে। ১ অনুপল= ০.০০৪ সেকেন্ড। ৬০ অনুপল= ১ বিপল=০.২৫ সেকেন্ড। ৬০ বিপল= ১ পল=১৫ সেকেন্ড। ৬০ পল= ১ দন্ড = ২৪ মিঃ। ২.৫ দন্ড =১হোরা =১ আওয়ার বা ঘন্টা। ৭.৫ দন্ড = ১ প্রহর = ৩ আওয়ার বা ঘন্টা। ৮ প্রহর = ১ দিবস (দিন+রাত্রি) বা অহোরাত্র। হোরা থেকে অহোরাত্র এসেছে। এখানে একটা জিনিস লক্ষণীয় যে ইং hour এবং হোরা শব্দটির সাদৃশ্য।
দিন ও রাত্রির ভাগ এরকম: – ২৫ দণ্ডে দিন = ১০ ঘণ্টা । ৩৫ দন্ডে রাত্রি =১৪ ঘণ্টা । এটা কিন্তু general । ঋতু এবং সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে দিন ও রাত্রির ভাগ পাল্টাবে। সূর্য্যোদয়ের সময়ের একটা বড় ভূমিকা পঞ্জিকার, সময়ের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঘটিকা: -১ দন্ড বা ২৪ মিঃ কে ঘটিকা বলা হয়। মুহূর্ত্ত = ২ দন্ড বা ৪৮ মিঃ । ব্রাহ্মমুহূর্ত্ত= সূর্যোদয়ের ২ মুহূর্ত্ত আগে অর্থাৎ ৯৬ মিঃ আগে বা ১ ঘণ্টা ৩৬ মিঃ পূর্বে। প্রদোষ= সূর্য্যাস্ত হতে ৫ দন্ড বা ২ ঘন্টা। রাত্রির প্রথম অর্ধপ্রহর বা ১ ঘণ্টা ৩০ মিঃ এবং শেষ অর্ধপ্রহরকে “দিবা” বলে। প্রথম অর্ধপ্রহরের পর অর্থাৎ ১ ঘণ্টা ৩০ মিঃ পর ৬ দন্ড বা ২ ঘণ্টা ২৪মিঃ কে বলে “রাত্রি”। তাহার পর ১০ দন্ড কাল বা ৪ ঘণ্টা কাল নিশা ও মহানিশা।
১৪০৬ বঙ্গাব্দের ৪ শ্রাবণ (১৯ জুলাই, ১৯৯৯) তারিখের লোকনাথ ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা থেকে পঞ্চাঙ্গের লিখনপদ্ধতি উদ্ধৃত করা হলো:
এখানে প্রথম স্তম্ভে ওপর থেকে নিচের দিকের সংখ্যাগুলি যথাক্রমে বার, তিথি, দং (দন্ড), পল ও বিপল নির্দেশ করে। এ হিসেবে ২ অর্থ সোমবার, ৭ অর্থ সপ্তমী তিথি, ৫৬ দং, ৩৩ পল ও ৩৭ বিপল। পঞ্জিকার ভাষায় একে প্রকাশ করা হয় দং ৫৬/৩৩/৩৭ রা এভাবে। ঘণ্টার হিসাবে এটি লেখা হয় ঘ ৪/১১/৩৭ এভাবে। অর্থাৎ এর দ্বারা বোঝায় যে, সন্ধ্যা থেকে ৪ ঘণ্টা ১১ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড পর্যন্ত সপ্তমী তিথির স্থায়িত্ব, পরে অষ্টমী তিথির আরম্ভ। উল্লেখ্য, ৬০ দন্ডে হয় ২৪ ঘণ্টা।
দ্বিতীয় স্তম্ভের প্রথম সংখ্যাটি নক্ষত্রনির্দেশক। নক্ষত্র হচ্ছে অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা ইত্যাদি ২৭টি। প্রত্যেকটির নির্দিষ্ট নম্বর আছে। ১৩ সংখ্যাটি এখানে হস্তা নক্ষত্রের নির্দেশক। এর সময়কাল দং ৪১/২৩/৪ রা ঘ ১০/৭/২৪। তৃতীয় স্তম্ভের প্রথম সংখ্যাটি বিভিন্ন যোগ নির্দেশ করে। যোগ হচ্ছে মাহেন্দ্র, বিষ্কুম্ভ ইত্যাদি ২৭টি এবং প্রত্যেকটিরই নিজস্ব নম্বর আছে। এখানে ২০ নম্বরে বোঝাচ্ছে শিবযোগ এবং এর সময়কাল হচ্ছে দং ৪৬/১৫/১২ রা ঘ ১২/৪/১৫। এ সময়ের করণ হচ্ছে গর (পঞ্চম করণ), এর পরে বণিজ করণ এবং দং ৫৬/৩৩/৩৭ রা ঘ ৪/১১/৩৭ গতে বৃষ্টিকরণ।
এছাড়া বাংলাদেশের পঞ্জিকায় প্রত্যেক পৃষ্ঠার বাম পাশে চন্দ্র কোনো রাশিতে রয়েছে তা কথায় লেখা থাকে। যেমন উপর্যুক্ত পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে ‘চন্দ্রো কন্যায়াং’ অর্থাৎ চন্দ্র কন্যা রাশিতে আছে। এছাড়াও কয়েকটি স্তম্ভ থাকে, যেমন: র ৩/১/৪১/১২, চং ৫/১৪/৩৮/০, মং ৬/১১/২০/৫৬, বু ৩/৩/১৮/৪৯, বৃ ০/১০/২৫/৪৬, শু ৪/৫/৫৭/১৫, শ ০/২১/৫/৩৩, রা ৩/২২/১১/৪১ এবং কে ৯/২২/১১/৪১। প্রথম স্তম্ভটি ব্যাখ্যা করলে পাওয়া যায়: র মানে রবি, ৩ মানে কর্কট রাশি এবং সময় হচ্ছে ১ ডিগ্রি ৪১ মিনিট ১২ সেকেন্ড। অর্থাৎ রবিগ্রহটি ওই তারিখে এক ডিগ্রি একচল্লিশ মিনিট বারো সেকেন্ডে কর্কট রাশিতে ছিল। অনুরূপভাবে চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু কোন রাশির কত ডিগ্রি, মিনিট ও সেকেন্ডে রয়েছে তা অঙ্কের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
পঞ্জিকায় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান সংকেতের মাধ্যমে দেখানো হয়, যেমন: র(৭), চং(১৩), মং(১৫), বু(৭), বৃ(১), শু(১০), শ(২), রা(৯) ও কে(২২)। এখানে র মানে রবি এবং ৭ মানে ৭ নম্বর নক্ষত্র পুনর্বসু, অতএব র(৭) দ্বারা বোঝায় রবিগ্রহটি রয়েছে পুনর্বসু নক্ষত্রে; অনুরূপভাবে চন্দ্র রয়েছে হস্তা নক্ষত্রে ইত্যাদি।
প্রকাশ থাকে যে, সিদ্ধান্ত জ্যোতিষশাস্ত্রের উদ্ভবের আগে পঞ্জিকায় দৈনন্দিন গ্রহাবস্থান লেখা হতো না। জ্ঞান বিকাশের ফলে পঞ্চাঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে গ্রহসঞ্চারকালও পঞ্জিকায় লিপিবদ্ধ হতে থাকে। বিগত ১০০ বছরের অধিককাল যাবৎ বাংলা পঞ্জিকা মুদ্রিত হচ্ছে। পঞ্জিকায় এখন ফলিত জ্যোতিষের অনেক কিছু অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্রের দৈনিক অবস্থানসমূহও পাওয়া যাচ্ছে। আধুনিক পঞ্জিকায় ফলিত জ্যোতিষ বিশেষ স্থান দখল করেছে। জনগণের চাহিদার দিকে দৃষ্টি রেখে এখন পঞ্জিকায় বর্ষফল, মাসফল, রাষ্ট্রফল, দৈনিক রাশিফল প্রভৃতি মুদ্রিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের পঞ্জিকার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। প্রাচীনের মধ্যে স্মার্ত রঘুনন্দন সম্পাদিত নবদ্বীপ পঞ্জিকার নাম পাওয়া যায়। রঘুনন্দনের পরে এর গণনার দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে রামরুদ্র বিদ্যানিধি (রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে) এবং বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব। কিছুদিন পরে এর গণনাকার্য বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজ আমলে কৃষ্ণনগরের জনৈক সমাহর্তার প্রচেষ্টায় বিশ্বম্ভর পুনরায় পঞ্জিকা প্রকাশের কার্যক্রম আরম্ভ করেন। এটি তখন পুথির আকারে লিখিত হতো। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে পঞ্জিকাটি মুদ্রিতাকারে প্রকাশিত হতে থাকে। তখন এটিই ছিল প্রথম মুদ্রিত পঞ্জিকা। পরবর্তীকালে ১২৯৭ বঙ্গাব্দ (১৮৯০) থেকে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা প্রকাশিত হতে থাকে। অনুরূপ পঞ্জিকা বোম্বাই ও পুনা থেকেও প্রকাশিত হয়। পঞ্জিকার সর্বশেষ সংস্কার করা হয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে একটি পঞ্চাঙ্গ শোধন সমিতি (ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটি) গঠন করে প্রচলিত পঞ্জিকাগুলির গণনাপদ্ধতির নিরীক্ষা ও প্রয়োজনবোধে সংস্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়। এই সমিতির পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পঞ্জিকা প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়। সে মতে ভারতে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে পঞ্জিকা প্রকাশিত হতে থাকে। বর্তমানে তা ১২টি ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলা পঞ্জিকায় বাংলা, ইংরেজি ও হিজরি সনের তারিখ, মাস ও বছরের উল্লেখ থাকে।
বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনার সনাতন নিয়মে কোন বছরের কোন মাস কত দিনে হবে তা আগে থেকে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তাছাড়া উক্ত গণনাপদ্ধতিতে কোন মাস ২৯ দিনে আবার কোন মাস ৩২ দিনে হয়ে থাকে। এ বিষয়টিকে জীবনের সর্বত্র বাংলা সন ব্যবহারের প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করে ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সভাপতিত্বে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত সংস্কার কমিটির প্রস্তাব অনুসারে বছরের প্রথম ৫ মাস ৩১ দিনের এবং পরবর্তী ৭ মাস ৩০ দিনের করা হয়।
১৯৮৮ সাল থেকে সরকারিভাবে খ্রিস্টীয় সনের পাশাপাশি বাংলা সন লেখার রীতি চালু হয় এবং তখন থেকে শহীদুল্লাহ্ কমিটির প্রস্তাবিত গণনাপদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির সম্পৃক্তির বিষয়টি মনে রেখে এবং প্রস্তাবিত গণনাপদ্ধতিকে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ও গ্রেগরীয় বর্ষগণনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে একই বছর বাংলা একাডেমীতে একটি শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। পঞ্জিকাকে আরও উন্নত ও ত্রুটিমুক্ত করার জন্য ১৯৯৫ সালে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রেরণায় একটি ‘টাস্ক ফোর্স’ গঠন করা হয়। পঞ্জিকা সংস্কারের জন্য তাদের সুপারিশ নিম্নরূপ: ১. সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জি বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাস ৩১ দিনে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত প্রতিমাস ৩০ দিনে গণনা করা হবে; ২. গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে, সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষরূপে গণ্য করা হবে এবং সেই বছরের ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে গণনা করা হবে; ৩. ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে এটি কার্যকর হবে এবং তারিখ পরিবর্তনের সময় হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে রাত ১২টায়। জনকল্যাণে গৃহীত এ পদক্ষেপ সর্বত্র প্রশংসিত হয়।
Comments